পদ্মা সেতু'র আদ্যোপান্ত : নামকরণ, রেকর্ড, সুবিধা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ

পদ্মা সেতু’র নামকরণ 

পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি ‘ পদ্মা সেতু ' নামকরণ করে ২৯ মে ২০২২ প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার । এতে বলা হয়েছে , ‘ সেতু বিভাগের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প ' - এর আওতায় মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্ত সংযোগকারী পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি সরকার পদ্মা সেতু ' নামে নামকরণ করলেন । ' রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেতু বিভাগের উপসচিব মো . আবুল হাসানের সই করা গেজেটে আরও বলা হয়েছে , ‘ জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে । এর আগে গত ২৪ মে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান , প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদ্মা নদীর নামেই সেতুর নামকরণ করা হবে ।

Nahian Bin Shafiq, CC BY-SA 4.0 , via Wikimedia Commons

পদ্মা সেতু'র যত রেকর্ড

১.গভীরতম পাইল : খরস্রোতা যে কোনো নদীতে সেতু নির্মাণে পাইলিং গভীর হতে হবে , অন্যথায় সেতু টিকবে না । আর পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই পদ্মার অবস্থান । সে ক্ষেত্রে এ সেতুর পাইলিং যতটা গভীরে নেওয়া যায় । প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন , পদ্মা সেতুতে মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে । পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি । এটি একটি বিশ্বরেকর্ড । 


২. ১০ হাজার টনের বিয়ারিং : রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকবে পদ্মা সেতু ৷ এর অন্যতম কারণ এই সেতুতে ব্যবহৃত ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং- এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। এটি একটি বিশ্বরেকর্ড |


৩. বিয়ারিং সংক্রান্ত আরেকটি বিশ্বরেকর্ড হলো এর পিলার । স্প্যানের মধ্যে ১০ হাজার ৫০০ টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে । পৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি ।


৪. নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সাথে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয় । এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র আর হয়নি । 


৫. কোনো নির্মাণ কাজে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় ভার্টিক্যাল আরসিসি বোর্ড পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট স্কিন ফিকশন , যা সেতুর দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে । এবং নদীর তলদেশের বহিঃভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে । অপরটি স্টিল টিউবুলার ড্রিভেন পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট করে পাইলের তলদেশের স্কিন ফিকরশন সমতা বৃদ্ধি করে ।


৬. দীর্ঘতম ট্রাস সেতু : পদ্মা সেতু বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রাস সেতু । এতদিন ট্রাস - প্রযুক্তিতে নির্মিত দীর্ঘতম সেতু ছিল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোদাবরী সেতু । এ সেতুর স্প্যান সংখ্যা ২৭। ট্রাস সেতু মূলত ভার বহন করবে বেশি , কিন্তু নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার হবে কম । নির্মাণে নেই খুব একটা জটিলতা , নকশাও হবে দৃষ্টিনন্দন । এসব কারণে বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় ট্রাস সেতু । 


৭. বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার : পদ্মা সেতু নির্মাণে পিলারের ওপর স্প্যান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে , যা একটি বিশ্বরেকর্ড । ক্রেনটি চীন থেকে আনা হয় । এর ভাড়া গুনতেও রেকর্ড গড়া হয়েছে । প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ শুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা । সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা । বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘ সময় ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে । 

Azim Khan Ronnie, CC BY-SA 4.0 , via Wikimedia Commons


সুবিধাসমূহ

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ - পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলা রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যুক্ত হলো । এটি চালু হওয়ায় শিল্পায়নসহ মোংলা ও পায়রা বন্দরের কার্যক্রমে গতি বাড়বে । দক্ষিণ - পশ্চিমাঞ্চলের মানু গ্যাস , বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা পাবে । পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এ এইচ -১ এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় এ সেতু চালু হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থাসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হবে ।


এক নজরে পদ্মা সেতু 

সেতুর নাম : পদ্মা বহুমুখী সেতু | ধরন : দ্বিতল ( ওপরে সড়ক এবং নিচে রেলপথ ) । প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জেলা : ৩ টি— মাওয়া , মুন্সীগঞ্জ ; শিবচর , মাদারীপুর ও জাজিরা , শরীয়তপুর সংযোগস্থল : মাওয়া , মুন্সীগঞ্জ ও জাজিরা , শরীয়তপুর । ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন : ৪ জুলাই ২০০১। নির্মাণকাজ উদ্বোধন : ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ | দৈর্ঘ্য : ৬.১৫ কিমি ( ২০,১৭৭.১৭ ফুট ) | প্ৰস্থ : ১৮.১০ মি ( ৫৯.৩৮ ফুট ) | সংযোগ সেতু ( ভায়াডাক্ট ) : ৩.১৪৮ কিমি | সংযোগ | সড়কসহ সেতুর মোট দৈর্ঘ্য : ৯.৩০ কিমি || অ্যাপ্রোচ রোড : ১২.১১৭ কিমি । নদী শাসন : ১৪ কিমি | নদীর পানি থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা : ১৮ মিটার ( প্রায় ) । লেন : ৪ টি । সেতুর আয়ুষ্কাল : ১০০ বছর | ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রা : রিখটার স্কেল ৯ | স্প্যান : ৪১ টি | পিলার বা পিয়ার : ৪২ টি | পাইল : ২৯৪ টি । নির্মাণের উপাদান : কংক্রিট ও স্টিল | প্রথম স্প্যান বসানো হয় : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ( ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে ) | ৪১ তম বা শেষ স্প্যান বসানো হয় : ১০ ডিসেম্বর ২০২০ ( ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে ) || রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হয় : ২৯১৭ টি | ল্যাম্পপোস্ট : ৪১৫ টি । নির্মাণকারী : চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড , চীন | নদী শাসক : সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন , চীন । নির্মাণ পরামর্শক : কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন ( KEC ) , দক্ষিণ কোরিয়া | টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে : কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ